Monday, December 23, 2013

আশা হতাশার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, গাজীপুর

গাজীপুরের শ্রীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কটি এখন এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ সাফারি পার্ক। এটি গড়ে উঠেছে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের সাফারি পার্কের আদলে। তিন হাজার ৬৯০ একর জমিজুড়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এই অনন্য উদ্যোগটি।পার্কে অবমুক্ত করা প্রাণিকুলের মধ্যে রয়েছে ২৬ প্রজাতির পশু-পাখি, ১১টি বাঘ, তিনটি সাদা সিংহসহ ১০টি সিংহ, ১০০টি ময়ূর, দুই শতাধিক হরিণ, চারটি জিরাফ, ছয়টি জেব্রা, ১৩টি বন গরু, চারটি হাতি, পাঁচটি ভালুক ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ কয়েক হাজার পশু ও পাখি। এসব প্রাণী দেখাশোনার জন্য রয়েছে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র ও সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।এ ছাড়া তথ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র, নেচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম, পার্ক অফিস, বিশ্রামাগার, ডরমিটরি, বন্য প্রাণী হাসপাতাল, কুমির পার্ক, লিজার্ড পার্ক, ফেন্সি ডাক গার্ডেন, ক্রাউন্ড পিজন এভিয়ারি, প্যারট এভিয়ারি, ধনেশ পাখিশালা, ম্যাকাউ ল্যান্ড, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, অর্কিড হাউস, প্রজাপতি বাগান, ক্লাইমেট হাউস, ভালচার কর্নার, ঝুলন্ত সেতু, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ফোয়ারা, বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ, সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র, ইকো-রিসোর্ট, ফুড কোর্ট, এলিফ্যান্ট শো গ্যালারি, বার্ড শো গ্যালারি, এগ ওয়ার্ল্ড ও শিশু পার্ক চালু করা হয়েছে। পার্কে প্রবেশ ফি : বয়স্ক প্রতিজন ৫০ টাকা, অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) ২০ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা, শিক্ষা সফরে আগত শিক্ষার্থী গ্রুপের (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পত্রসহ, ৪০-১০০ জন) জন্য ৪০০ টাকা, শিক্ষা সফরে আগত শিক্ষার্থী গ্রুপের (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পত্রসহ, ১০০ জনের উর্ধ্বে) জন্য ৮০০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য জনপ্রতি পাঁচ ইউএস ডলার।উপরের তথ্যগুলো সাফারি পার্ক উদ্বোধন হওয়ার পর পত্রিকায় প্রকাশিত,যারপরনাই অনেক আশা নিয়ে আমরা ৮ বন্ধু মিলে ঘুরতে গেলাম গাজীপুর সাফারি পার্ক।ঢাকা থেকে সরাসরি সাফারি পার্ক যাওয়ার কোন উপায় দেখলাম না,প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা নামতে হল,তারপর সেখান থেকে সিএনজি অথবা টু স্ট্রোকে সরাসরি সাফারি পার্কে যাওয়া যাবে।ভাড়া ৪৫০-৫০০টাকা।তবে সরাসরি যেতে না চাইলে উঠতে হবে লেগুনাতে।লেগুনা আপনাকে নামিয়ে দিবে বাঘের বাজারে।ভাড়া নিবে ৫০ টাকা জনপ্রতি।সেখান থেকে উঠতে হবে সিএনজি অথবা আরেক লেগুনাতে।নামিয়ে দিবে সাফারি পার্ক।ভাড়া ২০ টাকা জনপ্রতি।গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সাফারি পার্কের মোট দূরত্ব কমবেশি ২৩ কিমিঃ।সাফারি পার্কে যাওয়ার আগে খাবার অবশ্যই সাথে করে নিয়ে যাবেন,নয়ত আমাদের মত সারাদিন কলা রুটি খেয়ে থাকতে হবে,আশেপাশে ভালো কোনই খাবারের দোকান বা অন্য কোন ব্যবস্থা নাই।পার্কে পৌঁছানোর পর এবার টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকার পালা।হাতে নিলাম স্টুডেন্ট আইডি কার্ড,টিকেট কাউন্টার থেকে জানানো হল আইডি কার্ডের কোন ব্যবস্থা নাই।আমরা বললাম প্রধানমন্ত্রী তো বলছে স্টুডেন্টদের জন্য টিকেট ১০ টাকা,টিকেট কাউন্টার থেকে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে যা বলল তারপর আমরা আর কথা না বাড়িয়ে মনের দুঃখে ৫০ টাকা করে টিকেট কিনে ভেতরে গেলাম।আসলেই বিশাল জায়গা।ঢুকলাম আফ্রিকান সাফারি পার্কে।প্রথমেই চোখে পড়ল জিরাফের খাঁচা।আছে চারটি জিরাফ।কোনটিই খুব একটা বড় নয়।বাইরে থেকে জিরাফকে পাতা খাওয়ানো যায়।তবে মনে হচ্ছে জিরাফগুলি এখনো মানুষের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হতে পারে নি।কিছুদূরে আছে জেব্রা আর বাইসনের খাঁচা।একই খাঁচায় রাখা।আমরা মজা করে বলেছিলাম বাইসন আর জেব্রার ক্রসব্রীডিং করানো হবে,নতুন প্রানীটার নাম দেয়া হবে "বাইরা" :D একটু সামনেই আছে বিশ্রামাগার,বেশ খানিকটা উঁচু।সেখান থেকে দেখলাম বেশ দূরে জেব্রা আর বাইসন,তবে খাঁচায় নয়,পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের।আমরা বেশ খানিকটা কাছে গিয়েছিলাম।আর তখনই চোখে পড়ল হরিণও আছে তাদের সাথে। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতির প্রানীকুল যে কত অসাধারণ সুন্দর লাগে কেবল তখনি তা উপলব্ধি করলাম।

আফ্রিকাতে দেখার মত আর কিছু ছিলো না,ভাবলাম এশিয়াতে যাই।তেমন কিছু না পেয়ে গেলাম পাখীশালায়।ম্যাকাও ল্যান্ডে ঢুকতে গিয়ে আবারো ১০ টাকার টিকেট কাটতে হল।মনের দুঃখ কই রাখি। :( কিন্তু ঢোকার পর মনে হল ব্রাজিলের রিও,আহা সাফারি পার্কে আসা সার্থক।ম্যাকাও কাঁধে নিয়ে একটা ছবিও তুলে ফেললাম ;) ম্যাকাও ল্যান্ডে ম্যাকাও ছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের প্যারট।যদিও প্যারট এভিয়ারি নামে আলাদা একটা খাঁচা আছে,তবে ম্যাকাও ল্যান্ডে বেশ কিছু নতুন ধরনের প্যারট দেখতে পাবেন,সাথে বাঙ্গালী প্যারটও।ম্যাকাও ল্যান্ড থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম হাতি।কাছে গেলে হাতি আপনাকে শুঁড় বাড়িয়ে দেবে যেনো আপনি তাকে একটু আদর করে দেন ।হাতির মুহুরি একজন অফিসিয়ালকে দেখিয়ে হাতিকে বলেছিলো "সালাম দে" অমনি হাতি শুঁড় তুলে সালাম দিলো।দারুন লেগেছিলো ব্যাপারটা।


এরপর গেলাম ফেন্সি ডাক গার্ডেন।বেশ কিছু সাদা কালো রাজহাঁস সহ কয়েক প্রজাতির হাঁস আছে।আছে বোটে করে লেকে ঘোরার সুযোগ।বোট ভাড়া ১০০টাকা/৩০মি।যদিও আমরা বোটে চড়ি নাই,কিন্তু বোট বেশি সুবিধার মনে হল না :/ এরপর গেলাম ময়ুর দেখতে।আবারো ১০ টাকা টিকেট লাগলো।ভেতরে বসার সুন্দর জায়গা আছে।মাটি থেকে প্রায় ৭-১০ ফিট উচ্চতার ব্রীজের মত করা হয়েছে।ময়ুর গুলি নিচে থাকে।অনেকগুলি ময়ুর আছে।তবে সবগুলিই ছোট ছোট,বাচ্চা ময়ুর।

সবশেষে বাঘ আর সিংহ দেখার পালা।বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁতে গিয়ে বাঘ দেখতে হয়।অনেকখানি দূরে দেখলাম চারটি বাঘ।কিছুক্ষন পর চোখে পড়ল আরো দুটি।দূর থেকেই প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘ দেখে দারুন লাগছিলো।লাগছিলো বললাম এই কারনে যে কিছুক্ষণ পর একটা বাঘ রেস্তোরাঁর একেবারে সামনে চলে এলো।একবারে কাছ থেকে বাঘ দেখা।সবাই একেবারে হুরমুরিয়ে পড়ল বাঘ দেখার জন্য।
চিড়িয়াখানার সাথে এখানে ভিন্নতা হচ্ছে,এখানে বাঘ বাইরে আর আপনি খাঁচায়,মানে রেস্তরাঁয়।দেখতে দেখতে আরো দুটি বাঘ আমাদের সামনে চলে এলো।এর মধ্যে দেখলাম একজন অফিসিয়াল রেস্তোরার বাইরের করিডোরে গিয়ে বাঘকে আদর ও করে এলো।তবে সাধারনের জন্য সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ।এরপর গেলাম সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁয়।সেখান থেকে বেশ দূরে আমরা মোট নয়টি সিংহ দেখলাম।তবে বাঘের মত এরা কেউই কাছে আসে নি।অনেক দূরেই ছিলো।পার্ক থেকে বের হওয়ার পথে দেখলাম উটপাখি,এমু,কুমির,সাপ,কচ্ছপ,ধনেশ,বনবিড়াল,পাহাড়ি মুরগি,ঈগলসহ আরো কয়েক প্রজাতির প্রাণী । তবে হতাশ হই সাদা বাঘ আর সাদা সিংহ না দেখতে পেয়ে।জানতে পারলাম আরো পর্যবেক্ষনের পর এদের উন্মুক্ত করা হবে।প্রায় সব প্রজাতির প্রানীরই বাচ্চা সংস্করণ :P আনা হয়েছে পার্কটিতে,যেনো বড় হতে হতে এরা এদেশের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে। কার্প গার্ডেন,প্রজাপতি বাগান,অর্কিড হাউস,ঝুলন্ত ব্রীজ সহ অনেক কিছুই এখনো হয়নি।তবে অসম্পূর্ণ সাফারি পার্কটি এখনি বিনোদন আর শিক্ষার অনন্য স্থাপনা হয়ে গেছে।সাফারি পার্ক থেকে যখন বের হচ্ছি তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে।পার্কের বাইরে কোন যানবাহন রিজার্ভ না থাকায় আমাদের প্রায় দুই কিমিঃ হাটতে হল।যদিও পা ব্যাথা করছিলো,তবুও বন্ধুরা মিলে গ্রামের অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে খারাপ লাগছিলো না।রাস্তায় যাত্রা বিরতি করে টং দোকানে চা খেতে খেতে সৌভাগ্যক্রমে দুটি ভ্যানগাড়ি পেয়ে যাই আমরা।তাতে করে আসি বাঘের বাজার।ভাড়া নেয় জনপ্রতি ১০ টাকা করে।এরপর উলটো পথে ঢাকায়,সাথে করে নিয়ে এলাম বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের আশা হতাশার স্মৃতিটুকু :)